পীরগঞ্জ উপজেলার ১৫ নং কাবিলপুর ইউনিয়নের বিষ্ণপুর গ্রামের শ্রীরামপুর পাড়ার এক দিন মজুর হচ্ছে মোঃ আব্দুল হান্নান। বাবা খেজুর উদ্দিন এবং আছিয়া খাতুনের ছেলে তিনি। ছোট বেলা থেকে নানা রকম অভাব অনটনের মধ্যদিয়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। দিন মজুরের বেশে কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছেন। তার মজুরি দিয়ে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থা ছিল। কষ্টের পর কষ্টের দিন পেরিয়েছে কিন্তু কষ্ট লাঘব হয়নি। যদিও বর্তমানে তিনি একজন সফল চাষী। বর্তমানে জীবন তাঁর কাছে উপভোগ্য এবং আত্মমর্যদাপূর্ণ। তিন মেয়ে এবং এক ছেলের জনক মোঃ আব্দুল হান্নান পরম সুখেই জীবন যাপন করছেন। আর্থিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও মজবুত ভিত্তি গড়ার পাশাপাশি তাঁর সুখ্যাতি শুধু পীরগঞ্জ উপজেলাতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ধীরে ধীরে গোটা রংপুর জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। সফল চাষী হওয়ার সুবাদে ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টিভিটি প্রজেক্ট (আইএপিপি), ডিএই অংগের তিনি এখন একজন আদর্শ কৃষক।
গল্পের পিছনের গল্প:
দারিদ্র্য ও অনটন কবলিত জীবনের সেই ২০১২ সালের শেষের দিকে আইএপিপি, ডিএই অংগের আওতায় গঠিত বিষ্ণুপুর লাইভলিহুড ফিল্ড স্কুল (এলএফএস) এর ২৫ জন সদস্যদের মধ্যে তিনি প্রান্তিক চাষী হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হন। ফলে অত্র প্রকল্পের কৃষক প্রশিক্ষণের আওতায় উপজেলা কৃষি অফিস, পীরগঞ্জ থেকে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরীর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুবাদে সম্মানী ভাতা ৩০০ টাকার পাশাপাশি উপজেলা থেকে প্রকল্পের ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন কর্মকান্ডের আওতায় উপকরণ হিসেবে ৩,০০০ হাজার কেঁচো এবং ২টি মাটির চারি প্রদান করা হয়। পীরগঞ্জ কৃষি অফিসের নিদের্শনা মোতাবেক তিনি তাঁর বাড়িতে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেন। এরপর কেঁচো সার উৎপাদিত হলে তাঁর বসত বাড়ির আশেপাশে টমোটো, কপি, বেগুন, গাজর ও রসুনের ছোট ছোট জমির খন্ডে প্রয়োগ করে তিনি অভাবনীয় উৎপাদন লাভ করেন এবং তাঁর আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে উঠে যায়। এবার তিনি এলএফএস এর অন্যান্য কৃষক ও তাঁর বাড়ি আশে পাশের পরিচিত কৃষক ভাইদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। তাদের জমির এক পাশে ক্ষুদ্র প্লটে পরীক্ষামূলক ভাবে ভার্মিকম্পোস্ট সার প্রয়োগ করে ফলন পার্থক্য দেখাতে থাকেন। ফলে অপর কৃষকগণ তার উৎপাদিত কেঁচো সার তাদের জমিতে প্রয়োগে তীব্র আগ্রহী হয়ে উঠে। কেঁচো সার উৎপাদন প্রযুক্তির মধ্যে আব্দুল হান্নান অনেক সম্ভাবনা দেখতে পান। এটিকে তিনি পেশা এবং নেশা হিসেবে গ্রহণ করে প্রথমদিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন ও বিক্রির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লাভের টাকায় ধীরে ধীরে তাঁর পরিকল্পনা বড় হতে থাকে। বর্তমানে তাঁর খামার “তুহিন কেঁচোসার উৎপাদন খামার” নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
আব্দুল হান্নানের কারখানায় বর্তমানে ১৮ জন বেতনভুক্ত কর্মী কর্মরত আছেন। এই আঠারো জনের মধ্যে ১৪ জন কর্মী বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে কৃষকদল গঠন করে ৬৪৫ জন কৃষক সদস্য তৈরি করেছেন। তাঁর কর্মীরা সদস্য কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এবং সম্মানী ভাতা হিসেবে তাদেরকে বিনামূল্যে কেঁচো ও মাটির চারি সরবরাহ করেন যাতে কৃষক সদস্যগণও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। কর্মীদের কৃষক প্রশিক্ষণ এবং সদস্য কৃষকদের কেঁচোসার উৎপাদনের ব্যাপারটি তিনি রুটিনমাফিক মনিটরিং করে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনামত সেই কৃষকরা উদ্ধুদ্ধ হয়ে কেঁচো সার উৎপাদন করে তাদের জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি আব্দুল হান্নান এর কাছে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করে মুনাফা পাচ্ছেন।
তাঁর খামার থেকে ভার্মিকম্পোস্টের গড় উৎপাদন প্রতি মাসে ৩০-৩২ টন।
মোট ১৮ জন বেতনভুক্ত কর্মী কর্মরত আছেন।
সব খরচ বাদ দিয়ে তিনি প্রতিমাসে ৩৫,০০০-৪০,০০০ টাকা নিট আয় করেন।
পুরো রংপুর জেলায় প্রায় ১০-১২টি সারের ডিলার আব্দুল হান্নানের নিকট থেকে প্রতি কেজি ৮.৫০ টাকা মূল্যে কেঁচো সার খরিদ করে থাকে। বর্তমানে তাঁর কারখানা থেকে প্রতি মাসে ৩০-৩২ টন কেঁচো সার উৎপাদিত হয়। ফলে প্রতিমাসে সব খরচ বাদ দিয়ে তিনি ৩৫,০০০-৪০,০০০ টাকা নিট আয় করেন। তিনি এখন লাখোপতি কৃষক। তার অবস্থা পাল্টেছে। রীতিমত ১০০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে ফসল আবাদ করছেন। তাঁর এখন গোয়াল ভরা গরু এবং পুকুর ভরা মাছ রয়েছে। ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রির পাশাপাশি তিনি অন্যান্য বিশুদ্ধ কৃষি উপকরণও কৃষকদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। স্থানীয় পর্যায়ের পর জাতীয় পর্যায়ে তার সাফল্য ক্রমান্বয়ে স্বীকৃতি পাচ্ছে।
উত্তর সমূহ